তিস্তা, তিঞ্চুলে আর বরফ-পাহাড় - (the river and the iced peak)
নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনের ওভারব্রী্জ-এ
হাঁটছি, হঠাৎ চোখে পড়ল হিমালয়। দূরে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে,
কাঞ্চনজঙ্ঘা না? এখান থেকেই দর্শন মিলবে, এটা আশাতীত!
যাচ্ছি দিনতিনেকের হঠাৎ-ছুটিতে
সিলারিগাঁও। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং হয়ে ঘণ্টাচারেকের রাস্তা। হিমালয়ের কোলে ৬৫০০ ফিট
উচ্চতার এই ছোট্ট গ্রামটা থেকে শুনেছি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দারুণ লাগে।
কাছাকাছি শহর বলতে প্রায় ৪ কিমি
নীচে পেডং, সিলারির বাসিন্দা চব্বিশটি পরিবারের বাজার-হাট, পড়ুয়াদের স্কুল সবই ওই চড়াই-উৎরাই
ভেঙ্গে। দিলীপ তামাং ও তাঁর পরিবার তাঁদের হোম-স্টে তে স্নানের গরম জল, লাঞ্চ আর উষ্ণ
অভ্যর্থনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন । আর অপেক্ষায় ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। যখন পৌঁছলাম তখন সে
মেঘের আড়ালে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত।
বিকেলে চললাম রামিতে ভিউপয়েণ্ট-এর
দিকে। পাখির ডাক আর পাতার আওয়াজে ঘেরা একটা স্যাঁতসেতে পায়ে চলা রাস্তায় আমরা চারজন,
ডানদিকে তাকালেই দেখতে পাচ্ছি আমাদের খেয়াল রেখে চলেছে বিকেলের আলোয় সেজে ওঠা পাহাড়চূড়োগুলো।
রাস্তাটার শেষ রামিতে পয়েণ্টে। ওখান থেকে সামনে তাকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিবারকে একসাথে
দেখা যায়, আর নীচে তাকালে পাওয়া যায় তিস্তার চোদ্দোটা বাঁক। পুরো ল্যাণ্ডস্কেপ এককথায়
স্বর্গীয়।
পরদিন ভোরবেলায় বারান্দায় এসে
দেখি চারপাশ নিস্তব্ধ, সামনে ধ্যানগম্ভীর হিমালয়। আকাশে এক টুকরো মেঘও নেই। তখনো সূর্যের
আভা চূড়াগুলোয় আসেনি। বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়োগুলো সূর্যস্নানের অপেক্ষায় রয়েছে। একটু পরেই
দেখলাম কয়েক মিনিটের ঐশ্বরিক লীলা। কাঞ্চনজঙ্ঘা আর আশপাশের চূড়োগুলোয় সূর্য আলোর মুকুট
পরালো, তারপরেই সেই মুকুট সোনা হয়ে গলে ছড়িয়ে পড়ল বরফঢাকা পাহাড়গুলোর গায়ে।
ঘোর
একটু কাটতে প্রাতরাশের পর্ব মিটিয়ে দশটা নাগাদ বেরোনো হল সিলারিগাঁও-এর আশপাশ চষে বেড়ানোর
জন্য। প্রায় দুশো বছরের পুরনো সানচেনদোরজ়ি মনাস্ট্রিতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে পৌঁছলাম সাইলেণ্ট
ভ্যালিতে। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা সবুজ উপত্যকাটায় পাখির ডাক আর নিজেদের কণ্ঠস্বর ছাড়া
সত্যিই আর কোনো আওয়াজ পাচ্ছিলাম না।
পরবর্তী
গন্তব্য তিঞ্চুলে একটা ছোট্ট পাহাড়, ঘণ্টাদেড়েক লাগে চূড়ায় উঠতে। আগামী বছর সান্দাকফু
ট্রেক করার কথা হচ্ছে, ট্রেকিং-এর হোমওয়ার্কটা এখানেই সেরে নেওয়া যাক ভেবে বুকে বল
এনে শুরু করলাম ‘তিঞ্চুলে অভিযান’! ওঠানামার পথে কয়েকবার জিভ বের করে হাঁফানো আর দু’তিন
জায়গায় পা হড়কানো ছাড়া আমাদের ‘তিঞ্চুলে জয়’ বেশ ভালোই জমেছিল। বিশেষত চূড়ায় উঠে যখন
কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিনালচু শৃঙ্গ, জালেপ লা পাস, ভারত, নেপাল, ভূটানের সীমা নির্দেশ করা
ভূটাংলা পাহাড় দিয়ে সাজানো ল্যাণ্ডস্কেপ চোখে পড়ল, দেখলাম আকাশ এসে মিশেছে বরফঢাকা
পাহাড়গুলোর সাথে, তখন ভুলেই গেলাম একটু আগেই চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে নিজেকে আর তিঞ্চুলে-কে
যাচ্ছেতাই গাল পাড়ছিলাম।
এইসব
ওঠানামার ফলে লাগামছাড়া ক্ষিধে পেয়েছিলো, দুপুরে চারজনে মিলে প্রায় ছ’জনের খাওয়া খেয়ে
সেটা পোষ মানল। তিঞ্চুলে জয়ের ধকল আর শ্রীমতী তামাং-এর মারকাটারি রান্নার গুণে সিলারিগাঁও-এর
দ্বিতীয় বিকেলটায় আমাদের আর বেরনো হলো না। বারান্দা থেকেই দেখলাম আস্তে আস্তে রাত জেগে
উঠল পাহাড়ের কোল জুড়ে, আর জাগতে থাকা রাতের প্রহরায় রইল বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।