থাকে শুধু অন্ধকার
পুলু বিশ্বাস
![]() |
Photo Courtesy: Jaya Thakur |
রামানুজ একা মানুষ। স্ত্রী গত হয়েছেন বছরখানেক হল, একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে। প্রতিবেশীদের সাথেও খুব ঘনিষ্ঠতা নেই, বাজারে ডাক্তারখানায় যেতে আসতে যেটুকু হাসিমুখের আলাপ, তার বেশি খোঁজখবর কোনো পক্ষেই নেওয়া হয়না। সারাদিনের রান্না আর টুকটাক কাজের লোক বরুণ বিকেলে বাড়ি চলে যাওয়ার পর রামানুজের কাছে সন্ধেগুলো বড্ড লম্বা হয়ে যায়। প্রায়দিনই সময় কাটে স্ত্রীর ছবির সাথে কথা ব’লে।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দোতলা বাড়ির সামনে বেশ বড় আর সুন্দর একটা বাগান। ছেলে কলেজ হস্টেলে চলে যাওয়ার পর থেকে স্ত্রী কাদম্বরীর দিনের অনেকখানি সময় কাটতো এই বাগানে। গোলাপ, জুঁই, নানা রং-এর জবা, লিলি আর হরেকরকম মরসুমি ফুল সারাবছর বাগান জুড়ে থাকত। বাড়ি ঘিরে বেশ কটা নারকেল গাছও আছে।
অবসর নেওয়ার পরে রামানুজ
বাড়ির পিছনদিকে একটা ছোট্ট পুকুর কাটিয়েছিলেন। ওখানেই সময় কাটাতেন যখন কাদম্বরী বাগান করতেন।
স্ত্রী গত হবার পর এত বড় বাড়ি, এত বড় বাগান ,কে দেখভাল করবে, সেসব নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে নিচের তলাটা ভাড়া দেবেন বলেই ঠিক করেছিলেন। চেনা এক দালাল মারফত দুজন ভাড়াটে এসে
ঘরদোর দেখেছে, স্বামী-স্ত্রী আর এক কন্যার একটি পরিবারের সাথে পাকা কথা আজ বিকেলেই
হল। সামনের মাসের পয়লা তারিখে তারা এসে ঢুকবে। তার আগে ঘর পরিষ্কার করানো,
ফার্ণিচার দোতলায় সরানো, দেওয়ালের একপ্রস্থ চুনকাম করানো সারতে হবে। এসব ভাবতে
ভাবতে অখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল ওনার। ঘড়ি দেখলেন বাজে রাত ২ টো। কোনো আওয়াজ-এ ঘুম
ভেঙ্গেছে। মনের ভুল ভেবে চোখ বুজতে যাবেন, সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল মনে
হল। পরপর দুবার মনের ভুলে আওয়াজ শুনছেন? নাহ, দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা। "কে? কে এসেছ? কথা বলছ না কেন?" এতরকম হাঁকডাকেও কারো উত্তর পাওয়া গেল না। কি করবেন বুঝতে না পেরে
টর্চ হাতে চুপ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।
“আজ কাদম্বরী সাথে থাকলে এত চমকাতাম না" মনে মনে ভাবছিলেন। এবার পায়ের আওয়াজ তাঁর ঘরের বাইরে।
"কে এল রে বাবা এই রাতদুপুরে? চোর নয় তো?"
"বাড়িতে চুরি করার মত কিছুই তো আর নেই। বাপ্পার মায়ের গয়নাগাটি তো সবই বাপ্পাকে দিয়ে দিয়েছি। "
"কিসের আলো ওটা?!!"
দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে একটা খুব সরু আলোর রেখা ঘরে ঢুকছে।
"কে? কে ওখানে?"
মরিয়া হয়ে চিৎকার করলেন রামানুজ।
"আমি গো , আমি
"
কাদম্বরী না ??!! হ্যাঁ, কাদম্বরীই তো !!
"তুমি?? কোথায় তুমি??"
“দেখতে পাচ্ছো না আমায়?
এই তো আমি!”
কণ্ঠস্বর কাদম্বরীর। কিন্তু কাদম্বরী তো এই
পৃথিবীর কোথাও নেই।
"কাদম্বরী, তুমি কোথায়?"
বলতে বলতে রামানুজ খাট থেকে নেমে পড়লেন।
এবার আওয়াজ এলো "ডুম ডুম ডুম ডুম "
কিসের শব্দ এটা , মনে হছে
কাদম্বরী দরজা ধাক্কাছে। এই তো, এক্ষুণি এখানেই ছিল। "কাদম্বরী?" আবার ডাকলেন।
দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই।
এমন সময়ে লোডশেডিং। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। হাওয়ার শব্দে বাকি সব আওয়াজ ঢেকে
যাচ্ছে, তবুও হাল্কা "ছলাৎছলাৎ" আওয়াজটা শুনতে পেলেন রামানুজ। পুকুরের
দিক থেকে আসছে।
কাদম্বরী কি জলে নামলো এই
ঝড়বাদলের রাতে? অদ্ভুত মানুষ তো! আগে বোঝা যায়নি ভদ্রমহিলার এসব বদখেয়ালের কথা। তখন
সংসারের গণ্ডির মধ্যে ছিলো, এসব শখ মনে পুষে রেখেছিল। এখন ঝাড়া হাত-পা হয়ে মনের
সুখে মাঝরাতে পুকুরে নেমেছেন মহারাণী। এই বুড়োটার কথা একবারও যদি ভাবে! যেদিন দুদিনের
জ্বরে পড়ে ড্যাংডেঙ্গিয়ে চিতায় উঠলো সেদিনও ভাবেনি বুড়োটা কার কাছে থাকবে, আজও
ভাবছে না এই রাত্রে বৃষ্টিতে ভিজলে রামানুজের কি হাল হবে। ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পুকুরের কাছে এলেন
তিনি।
"কাদম্বরী, তুমি কি পুকুরে
নেমেছ?" হেঁকে উঠলেন রামানুজ। উত্তরে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ এল। জলে নেমে এতটাই
মশগুল গিন্নি যে ভাল করে কথা বলারও দরকার মনে করছেন না।
"উফ। তুমি কী? এই রাত্রে
কি করছ ওখানে। উঠে এসো এক্ষুণি " রামানুজ অন্ধকারেই এগোলেন।
পুকুরের সিঁড়িগুলো অন্ধকারে
ঢাকা , মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
মনে হচ্ছে কাদম্বরী মাঝ পুকুরে
স্নান করছে।
"তোমার কি মাথা খারাপ
হয় গেছে? মাঝ রাত্রে পুকুরে নেমেছ? ফিরে এস এখানে। "
কোনো উত্তর না পেয়ে, রামানুজ
পুকুরে ঝাপ দিলেন।
"মাথা খারাপ হয়ে
গেছে কাদম্বরীর। মারা যাবার পর এরকম হয় নাকি? এই মাঝ রাত্রে পুকুরে নেমেছে "
এই ভাবতে ভাবতে সাঁতার কেটে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি যত এগোচ্ছেন, কাদম্বরী
তত দূরে চলে যাচ্ছে।
"অতদূরে কেন চলে
যাচ্ছো তুমি? আমি আর পারছিনা জল কেটে এগোতে" জলের মধ্যে চিৎকার করে উঠলেন।
সাঁতার কাটতে কাটতে খুব ক্লান্ত
হয়ে পড়লেও রামানুজ ঠিক করেছেন কাদম্বরীকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না। কিন্তু কাদম্বরী
কোথায়?
“ওই তো, ওই পাড়ে উঠেছে মনে
হচ্ছে। কতক্ষণ আর সাঁতরাতে পারবে?" সাঁতার কাটতে কাটতে রামানুজ পাড়ে পৌঁছলেন।
কিন্তু এ কি! নেই নেই নেই। কাদম্বরী কোত্থাও নেই। আর দম নিতে না পারা শরীরটাকে
পাড়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে রামানুজ বসে পড়লেন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল এবার।
“কেন? এলেই যদি, মিথ্যে
আশা দিয়ে চলে গেলে কেন? কি দরকার ছিলো এতক্ষণ মজা করার? খুব ভালো লাগছে্, না! আমি
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি, তোমায় খুঁজে না পেয়ে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার, এগুলো দেখে
খুব আনন্দ হচ্ছে তোমার, বলো? আমি আর পারছিনা কাদম্বরী, আমায় তোমার কাছে নিয়ে চলো।
আর কতদিন?”
ভোর হয়ে আসছে, রামানুজ
শুয়ে পড়েছেন পুকুরের পাড়ে। কি হবে আবার ওই দোতলা বাড়িটায় ফিরে গিয়ে? কাদম্বরী তো কোথাও
নেই। ঘুম আসছে রামানুজের। ভোরের হাওয়ার আলতো ছোঁয়ায় সে বড় আরামের ঘুম।
রাত্রের ঝড়ে পুকুরপাড়ের
নারকেল গাছ থেকে খসে পড়া ডাবগুলো পুকুরের জলে আওয়াজ তুলছে “ছলাৎছলাৎ"।।