পনেরোই আগস্টের সকাল। একটু পরে স্বাধীনতা
দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হবে। তারই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীরা।
নাচের পোশাক, পতাকা উত্তোলনের আয়োজন, অভিভাবকদের যত্ন-আত্তি, সবকিছুর তদারকিতে
ব্যস্ত ওরা।
‘ওরা’ কারা জানো? যাদের
আমরা ‘বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ’ আখ্যা দিয়ে
কিছুটা সহানুভূতি আর অনেকটা কৌতূহলের দৄষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত, ওরা সেইসব মানুষজন,
যারা নানা প্রকারের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে আজন্ম সঙ্গী করে নিরলস চেষ্টা
করে চলেছেন ভাল থাকার ও আশপাশকে ভাল রাখার।
ওদের এই চেষ্টার সঙ্গী বেশ কিছু সংস্থার
মধ্যে একটি হলো SHELTER: Society for Help, Education, Love, Training and Employment for the
Retarded.
1992-র সেপ্টেম্বরে পাঁচজন ছাত্রছাত্রীকে
নিয়ে তাদের পথে যাত্রা শুরু Shelter-এর। সংস্থার সচিব
শ্রী অশোক চক্রবর্তীর হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে একঝাঁক নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকার
উদ্দীপনায় গড়ে ওঠে এই ডে কেয়ার সেণ্টার ও বিশেষ শিক্ষার স্কুলটি। কুড়ি বছর পেরনো
সংস্থাটির বর্তমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় দেড়শো।
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের ফা৺কে ফা৺কে
শ্রী চক্রবর্তীর কাছে জেনে নিচ্ছিলাম ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের কিছু কথা।
গঙ্গার ধারে মনোরম পরিবেশে বাগান দিয়ে
ঘেরা সংস্থাটিতে রয়েছে নানা পরিষেবার আয়োজন। বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য স্কুল,
ভোকেশনাল ট্রেনিং সেণ্টার ও ওয়ার্কশপ, কাউন্সেলিং ও বিভিন্ন ধরনের থেরাপির
ব্যবস্থা-সমেত বিশেষ ক্লিনিক, এসবই SHELTER-এর
কর্মসূচীর অঙ্গ।
স্কুলে আসা প্রত্যেক ছাত্র ও ছাত্রীর
প্রয়োজন ও দক্ষতা অনুসারে চলতে থাকে তাদের দৈনন্দিন শিক্ষা ও কর্মসূচী। অভিভাবকদের
জন্যও থাকে নানা ব্যবহারিক পরামর্শ। এভাবেই নানা কাজে, তা সে নিজের ও বাড়ির লোকের
পোশাক-আশাকের যত্ন নেওয়া, ঘর পরিষ্কার রাখাই হোক, বা, সবজি কাটা, বাজার করা,
টাকা-পয়সার হিসাব রাখা, যে কোন কাজেই ওরা সবাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
কারিগরী দক্ষতায় আত্মবিশ্বাস আর নৈপুণ্য গড়ে
দেয় ভোকেশনাল ট্রেনিং সেণ্টার ও ওয়ার্কশপ। হস্তশিল্পের বিভিন্ন ধরন নিয়ে এখানে
ছাত্রছাত্রীরা কাজ করেন। পুরনো কাপড় দিয়ে তাঁতে বোনা বিভিন্ন জিনিস, পর্দা,
পাপোষ, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ, পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ, ঘর সাজানোর সামগ্রী,
ক্যালেণ্ডার, বিভিন্ন স্বাদের আচার, টোম্যাটো সস –- এইসবকিছুই
ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের তৈরি। এক-একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হস্তশিল্পের বিভিন্ন
শাখায় সক্ষম হয়ে ওঠেন ওরা।
কারিগরী শাখা ‘সৄজনী’ বছরে দু’বার স্কুল-চত্বরে প্রদর্শনী আয়োজন করে, বিশ্বকর্মা পূজা ও
সরস্বতী পূজার দিনে।
SHELTER-এর সদস্যদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী
হলো ভদ্রেশ্বর এলাকায় CESC Electricity
Bill Distribution Project। প্রায় ২২০০০ বিদ্যুত-বিল বিতরণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত
সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। এই কর্মসূচী যে ওদের আত্মবিশ্বাস আর আয় বাড়ায় তা-ই নয়,
ভদ্রেশ্বর এলাকার ২২০০০ পরিবারে বার্তা পৌঁছে দেয় “ওরাও পারে, সবরকম
প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ওরা পারে”, ওদের এই পারার
গল্প লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
লেখাপড়া, কাজ শেখা এসবের পাশাপাশি
সমানতালে চলতে থাকে সাংস্কৄতিক কাজকর্মও। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে বার্ষিক অনুষ্ঠানে
তো বটেই, সারা বছর ধরেই স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ, গান, আবৄত্তি, নাটকের
আয়োজন করেন এখানকার সদস্যরা।
সাধারণত, একটি শিশুর জন্মের পর যদি জানা
যায় তার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও যত্নের প্রয়োজন রয়েছে, তখন অনেকক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে
শুরু হয় ভাগ্যকে দোষারোপ করা। এইভাবে শিশুটির জীবনের অনেকখানি মূল্যবান সময় নষ্ট
হয়ে যায়। যখন বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে শিশুর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিকে নজর
ফেরানো হয়, ততদিনে পারিপার্শ্বিক থেকে তার শিক্ষাগ্রহণের ক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু
করেছে।
যদিও ছবিটা বোধহয় ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। কথা হচ্ছিলো স্কুলের জন্মলগ্ন থেকে
সঙ্গে থাকা শিক্ষিকা শ্রীমতী চায়না রায়ের সাথে। তাঁর কাছে জানা গেলো সময়ের সাথে
সাথে SHELTER-এ আসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ শিশুর বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অভিভাবকরা অনেক আগেই অনুভব করতে পারছেন। এটি
নিঃসন্দেহে জনচেতনাবৄদ্ধির সুফল এবং যেকোনোরকম প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানো শিশুদের
ভবিষ্যতের পক্ষে সুলক্ষণ।
যাত্রা শুরুর দিন থেকে সঙ্গে থাকা আরেকজন
শিক্ষিকা শ্রীমতী রঞ্জনা গাঙ্গুলি শোনালেন হোস্টেলের গল্প। ওনার তত্ত্বাবধানে
রয়েছে ছেলেদের জন্য ত্রিশ শয্যাবিশিষ্ট একটি তিনতলা হোস্টেল। জানা গেলো হোস্টেলে রয়েছেন
সুদূর রায়গঞ্জ, শিলং থেকে আসা ছাত্ররাও। আবাসিক ছাত্রদের সাথে ‘হোস্টেল সুপার’ রঞ্জনাদির সম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে ওনাকে ছাত্ররা নিজেদের
পরিবারের সদস্য বলেই ভাবেন।
মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে নয়,
সেই প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়েই কিভাবে পথ চলা যায়, জীবনের প্রতিটি আনন্দ উপভোগ
করা যায়, কুড়ি বছর ধরে বহু মানুষকে SHELTER তা
শেখাচ্ছে।
২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া Best Institution Award, ২০১২ সালে শ্রী কপিল সিবালের হাত থেকে নেওয়া 10th AIWEFA Nina Sibal Memorial Award, এসব তো আছেই, তবে আরো বড় পুরষ্কার বোধহয় ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস, তাদের
মুখের হাসি, তাদের হাতের কাজ, তাদের নিজেদের চিন্তাধারায় গড়ে তোলা দেওয়াল-পত্রিকা,
তাদের মনের সৄষ্টির আনন্দ।
খুব ইচ্ছে ছিলো কয়েকজনের সাথে স্বাধীনতা
দিবসের অনুষ্ঠানের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার। কিন্তু সবাই তখন “ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন-রঙ্গিন”, “উঠো গো ভারতলক্ষ্মী”, “বন্দেমাতরম”-এ এতই মগ্ন, যে, সেই মগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটাতে মন চাইলো না।
বাইরে অঝোরধারে বৄষ্টির কল্যাণে ছবি তোলার পরিকল্পনা-ও স্থগিত রইলো। মনে মনে ঠিক করলাম এবারে এটুকুই থাক,
সেপ্টেম্বরে বার্ষিক অনুষ্ঠান দেখতে আর দেওয়াল-পত্রিকার কথা জানতে আবার আসবো, বাকি
রয়ে যাওয়া ইচ্ছেগুলো নাহয় সেদিনই মেটাবো!