Online Magazine

প্রবাসীর চিঠি

                                                        

                                                        
                                              প্রবাসীর চিঠি 
                                
                                            শ্বেতা রায়চৌধুরী

সুবু রে,

 আজ আমি শস্য শ্যামল সবুজ রূপসী বাংলার থেকে অনেক দূরে কিন্তু মন পড়ে আছে ওখানেই। দুর্গাদালানে রথের দিনে কাঠামো পূজো, তার উপর মাটি দিয়ে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী রূপ আর মহালয়াতে দেবী পক্ষের সূচনার শুভ লগ্নে দেবীর চোখ আঁকা, সব বেশ উপভোগ করছিস, কি বল। আর আমি! সেই সব থেকে বহুদূরে বসে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছি।

আজ যেন বেশি করে মনে পড়ছে সেই ছোটবেলার কথা। সেই কাঠামোতে মাটি লাগানোর দিন থেকে শুরু হত আমাদের দুর্গাদালানে যাতায়াত। পালজেঠু কি করলেন সেই দেখতে প্রায় দিনই ভিড় করতাম। নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা দেখলেই আর স্কুলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে ভাল লাগতো না। মনে হত ওই সাদা মেঘের মত করে উড়ব। তারপর ক'দিন, সে কি আনন্দ!

সোনালী হয়ে আসা ধানের ক্ষেত আর সাদা কাশ ফুল দেখলেই বুঝতাম পুজো আসছে। বাবার দেওয়া নতুন জামাটার গন্ধ শুঁকতাম বার বার। পুজোর পাঁচটা দিন যে কোনদিক দিয়ে চলে যেতো কে জানে... কোন বাধা নেই, বারণ নেই, পড়া নেই... শুধুই মুক্তির গন্ধ। মনে পড়ে? অষ্টমীর দিন প্রত্যেকবার তোর, আমার আর তিতিরের উপর ফুল তোলার ভার দেওয়া থাকত। শিউলি, টগর আরও কত ফুল তুলতাম আমরা। সন্ধ্যারতির সময় ধুনুচি নৃত্য আর রাত জেগে নাটক দেখা– আজ যেন সব গল্প মনে হয়।

দশমীর দিনটা একটু মন খারাপ করত কিন্তু বিজয়ায় মিষ্টির লোভটা যেন সেটা একটু কম করে দিত। আর বিসর্জনের সময় কি খারাপই না লাগতো মনটা! মনে হত নিজের মা-ই দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে অনেক দিন বাদে ফিরবে। এই অনেক দিন বাদে ফিরে আসবে এই আশা নিয়ে আবার পরের পুজোর অপেক্ষা করতাম।

এখানেও পুজো হয়। খুব ভক্তি ভরেই হয়। সবাই পুজোর কটা দিন আনন্দেই কাটাই। কিন্তু বাংলার সব কিছুই খুব আপন। দূর্গাপুজোর সময় নীল আকাশ থেকে ছোট্ট ঘাসও নিজেদের সুন্দর করে সাজায়। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত মনের আবেগ মিলে মিশে একাকার হয় এই পুজোর সাথে। এখানে আমরা পুজো কবে জানি ক্যালেন্ডার দেখে। আর তোরা জানিস প্রকৃতির সাজ সাজ রবে, নির্মেঘ নীল আকাশটা দেখে।

আমার চিঠি পড়তে পড়তে হয়ত ভাবছিস আমি বদলে যাওয়া সময়ের কথা ভুলেই গেছি। জানি রে এখন মানুষের মনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সাজগোজ, জামাকাপড়, প্রতিমা, প্যান্ডেল সবই বড্ড বেশি বাণিজ্যিক। শহরে এখন একটা রুমালের মাপের ঘোলাটে আকাশ দেখা যায়। শিউলি, কাশ চাপা পড়ে গেছে বহুতল বাড়ির ভিড়ে। আর গ্রামের দারিদ্র‍্য ঢেকে দিয়েছে শরৎকালের গ্রামীণ সৌন্দর্য। এতটা বাণিজ্যিক হওয়ার পরও কোথাও যেন একটা পুজোর গন্ধ, মনের আবেগ আর প্রাণের টান এখনও আছে।

বার বারই মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া রবিঠাকুরের কবিতাটা–
যেদিকে তাকাই সোনার আলোয়
দেখি যে ছুটির ছবি
পূজার ফুলের বনে ওঠে ওই
পূজার দিনের রবি।।

এবারে আর যাওয়া হলো না রে। ছুটি পেলামনা। তুই খুব আনন্দ করিস পুজোয়। বাড়িতে দূর্গাপুজো কেমন হল জানাবি।

শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল।

                                                                                  – তোর প্রবাসী বন্ধু মিঠাই ।।